ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিদ ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে সরকারের গঠিত একটি উপদেষ্টা ফোরাম থেকে পদত্যাগ করেছেন দেশটির শীর্ষ ভাইরাস বিশেষজ্ঞ শহীদ জামিল।
করোনার দাপটে মৃত্যুপুরীতে রূপ নেয়া দেশটিতে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বেশ কিছুদিন ধরেই নরেন্দ্র মোদির সরকারের নেয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে আসছিলেন তিনি।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস শনাক্তে এবং এ নিয়ে গবেষণার লক্ষ্যে ইন্ডিয়ান সার্স-কোভ-টু জেনেটিকস কনসোর্টিয়াম বা ইনসাকগ ফোরাম তৈরি করেছিল মোদি প্রশাসন।
কিন্তু করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের সরবরাহকৃত তথ্য-প্রমাণের দিকে কর্তৃপক্ষের একেবারেই নজর নেই বলে অভিযোগ ছিল ড. শহীদ জামিলের।
এমন পরিস্থিতিতে তিনি পদত্যাগ করলেও সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেননি তিনি। পদত্যাগের খবর সঠিক উল্লেখ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ক্ষুদে বার্তায় তিনি লিখেন, ‘কারণ জানাতে আমি বাধ্য নই।’
তবে সেই ক্ষুদে বার্তায় জামিল জানান, তাকে গত শুক্রবার ফোরাম থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে একটি কলাম লেখেন জামিল। সেখানে তিনি লেখেন, ‘ভারতে প্রমাণসাপেক্ষ নীতি গ্রহণে তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।’
কলামে তিনি নরেন্দ্র মোদির সরকারের করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে স্বল্পসংখ্যক নমুনা পরীক্ষা, ধীর গতির টিকাদান, টিকার ঘাটতি এবং স্বাস্থ্যখাতে জনবলের ব্যাপক সংকট নিয়ে কথা বলেন।
তিনি লেখেন, ‘এই সংকটগুলো সমাধানের ওপর বারবার জোর দিচ্ছেন আমাদের বিজ্ঞানীরা। কিন্তু প্রমাণসাপেক্ষ নীতি নির্ধারণে তাদের মত উপেক্ষা করার যেন সিদ্ধান্তই নিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।’
দেশটিতে করোনাভাইরাস বিষয়ক তথ্য সংগ্রহে ফাঁকফোকরের কথা উল্লেখ করে শহীদ জামিল লিখেন, ‘গত ৩০ এপ্রিল আট শতাধিক ভারতীয় বিজ্ঞানী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তারা বিশদ গবেষণার জন্য তথ্যে তাদের প্রবেশাধিকার দেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। মহামারির গতিপ্রকৃতির পূর্বাভাস ও ভাইরাসে বিস্তার নিয়ন্ত্রণে এটি জরুরি ছিল।’
তিনি আরও লেখেন, ‘কেবল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়াও আত্মঘাতী পদক্ষেপ। এতে দিনে দিনে মহামারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। যে হারে মানুষ মরছে, আমাদের জাতীয় জীবনে এটি স্থায়ী কলঙ্ক হয়ে থাকবে।’
ভারতের শীর্ষ ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ড. শাহিদ জামিল।
চলতি মাসে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চে ভাইরাসের ব্যাপকতা এবং দেশজুড়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে আগেই সরকারকে সতর্ক করেছিল শহীদ জামিলের ইনসাকগ।
করোনার বি.১.৬১৭ প্রজাতিটিই ভারতে চলমান করোনা তাণ্ডবের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। বৈশ্বিক মহামারির এ পর্যায়ে ভারতে করোনায় প্রতিদিন গড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন চার হাজারের বেশি মানুষ।
কেন ভারত সরকার বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা শোনেনি, বিশেষ করে জনসমাগম নিষিদ্ধের মতো বিষয়ে, সে প্রশ্নে রয়টার্সকে ড. জামিল বলেন, করোনা প্রতিরোধে নীতিমালা গ্রহণে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় মনোযোগ দিচ্ছিল না কর্তৃপক্ষ।
মহামারির বাস্তবতা উপেক্ষা করে পাঁচ রাজ্যে মাসব্যাপী বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ, প্রচারণা ও জনসমাবেশ; হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব কুম্ভমেলায় কোটি মানুষের অংশগ্রহণের পরপরই অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।
ব্যাপক সমালোচনার পরেও নির্বাচনি সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ভারত সরকারের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের অনেকে।
করোনায় প্রাণহানিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের পরের অবস্থান ভারতের। দেশটিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা পৌনে তিন লাখের কাছাকাছি।
সংক্রমণ শনাক্তের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ ভারত। দেশটিতে এ নিয়ে ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে আড়াই কোটি মানুষের দেহে।
রোববার ২৪ ঘণ্টায় ভারতে তিন লাখ ১১ হাজার মানুষের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে চার হাজার ৭৭ জনের।
ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে করোনার টেস্ট কিট, ওষুধ, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সরঞ্জামের। রোগীর বিপরীতে স্বাস্থ্য খাতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক লোকবল সংকট।
মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হতে থাকায় শ্মশান, কবরস্থানগুলোতেও স্বজনদের মরদেহ নিয়ে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে।
এমন পরিস্থিতিতে সৎকারের খরচ তিন গুণ বেড়ে ১৫ হাজার রুপি ছাড়িয়েছে অনেক জায়গায়। সৎকার ছাড়াই নদীতে ভাসিয়ে অথবা মাটিচাপা দেয়া হচ্ছে অনেক মরদেহ।
কারণ শেষকৃত্যে বিপুল খরচ আর চিতায় পোড়ানোর জন্য কাঠের ঘাটতির ফলে দরিদ্র মানুষদের জন্য স্বজনদের অন্তিম যাত্রায় ধর্মীয় রীতি নিশ্চিত করে মরদেহ পোড়ানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।